একাদশ অধ্যায়
বিবেকের নীরব কণ্ঠস্বর
সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর প্রত্যেক মানুষকে দেহ-মন-আত্মা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন । সেই সাথে প্রতিটি মানুষকে তিনি দিয়েছেন একটি সত্যময় বিবেক যা হলো ঈশ্বরেরই কন্ঠস্বর। যে ব্যক্তি তার বিবেকের লালন-পালন ও সুষ্ঠু গঠনে যত বেশি যত্নবান, তার বিবেক তত বেশি সুস্থ ও পবিত্র। যার বিবেক যত বেশি সুস্থ ও পবিত্র, সে তত বেশি স্পষ্টভাবে তার অন্তরে ঈশ্বরের কন্ঠস্বর শুনতে পায় । বিবেক হলো মানুষের অন্তরের গোপন অন্তস্থল এবং ঈশ্বরের পবিত্র মন্দির । সেখানে সে ঈশ্বরের সাথে একান্ত নীরবে নিভৃতে বাস করে, সেখানে ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হয়। সেখানে বিবেক অতি সুন্দর করে ঈশ্বরের আজ্ঞাগুলো প্রকাশ করে, যা ঈশ্বর-প্রেম ও মানব-প্রেমে পরিপূর্ণ । আমাদের ঈশ্বর জীবন্ত ও প্রাণবন্ত, তিনি আমাদের অন্তরে থাকেন এবং তাঁর বাণী আমাদের কাছে প্রকাশ করেন । আমাদের প্রতিদিনকার জীবনের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে, কাজে-কর্মে, চিন্তা-ভাবনায় তিনি নীরবে আমাদের কাছে কথা বলেন ।
তাই ঈশ্বরের কথা শোনার জন্যে আমাদের চাই সুন্দর ও সুস্থ বিবেক এবং অন্তর-আত্মার গভীরে নীবরতা । ঈশ্বর কখনো চিৎকার করে বা উচ্চস্বরে কথা বলেন না, বরং তিনি নীরবে স্পষ্ট করে কথা বলেন । সুন্দর-সুস্থ বিবেক ঈশ্বরের বাণী নীরবে শ্রবণ করে এবং সেই বাণী আমাদের বলে দেয় কোটি করা, বলা ও কোন্ চিন্তা করা আমাদের জন্য সঠিক, আর কোনটি সঠিক নয়, কোটি ন্যায় এবং কোটি অন্যায় । কেননা আমাদের বিবেক হলো ঈশ্বরের নীরব কন্ঠস্বর ।
এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
মূল্যবোধ
মূল্যবোধ বলতে এমন কিছুকে বোঝায় যার বিশেষ মূল্য বা গুরুত্ব রয়েছে--যা আকর্ষণীয়, প্রশংসনীয়, সমর্থনযোগ্য--যাকে পাবার জন্যে আমাদের হৃদয়ে আকাঙ্ক্ষা জাগে এবং যা জীবনের সুন্দর লক্ষ্য অর্জনে মানদণ্ড হিসেবে কাজ করে । তাই জীবনে মূল্যবোধ থাকা প্রতিটি মানুষের জন্যেই একান্ত প্রয়োজনীয় ।
মূল্যবোধহীন মানুষের জীবন মূল্যহীন ও অর্থহীন। মূল্যবোধহীন মানুষকে কেউ সম্মান করে না, সে নিজেকে ইতর প্রাণীতে পরিণত করে । যে মানুষের সুন্দর মূল্যবোধের জ্ঞান আছে এবং সেই অনুসারে জীবন যাপন করে, সে সকলের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র/পাত্রী হয় ।
মূল্যবোধ মানুষের জীবনে নৈতিক জীবন গঠনে সাহায্য করে যা তার বিচার-বিবেচনায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে এবং সেই অনুসারে জীবন পরিচালনা করতে ব্যক্তিকে সাহায্য করে ।
মূল্যবোধ ও বিবেক
মূল্যবোধের সাথে আমাদের বিবেকের একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এই দুইটি একে অপরকে প্রভাবিত করে । যে ব্যক্তির সঠিক ও উন্নত মূল্যবোধ রয়েছে, তার বিবেকও সঠিক ও মহৎ হয়। অন্যদিকে, যার বিবেক সঠিক ও পবিত্র, তার মূল্যবোধগুলোও সঠিক ও উচ্চমানের হয় । উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে ব্যক্তি পবিত্রতা, সততা ও সৌজন্যবোধকে নিজ জীবনের মূল্যবোধ হিসেবে গ্রহণ করে মর্যাদা দেয় সেই ব্যক্তি সঠিক বিবেকের অধিকারী হয় । অন্যদিকে, যে ব্যক্তির বিবেক সুস্থ, সঠিক ও পবিত্র, সে পবিত্রতা, সততা, সবার সাথে সুসম্পর্ক ইত্যাদি মূল্যবোধকে জীবনের মানদণ্ড ও চালিকাশক্তি হিসেবে স্থান দেয় ।
আবার এর বিপরীতে যে ব্যক্তির মূল্যবোধ সঠিক ও উন্নত নয়, তার কাছ থেকে সুন্দর বিবেক আশা করা যায় না । অন্যদিকে দেখা যায়, যার বিবেক সঠিক নয়, তার মূল্যবোধসমূহও ভ্রান্ত ও অমার্জিত । উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, যাদের জন্ম ও বসবাস কলুষিত পরিবেশে এবং যারা ঐ পরিবেশে ঝগড়া-বিবাদ, গালাগালি ও বিভিন্ন অপরাধের মধ্যে বাস করছে তাদের কাছ থেকে সৌজন্যবোধ, নম্রতা, সুন্দর আচরণ খুব বেশি আশা করা যায় না । এরূপ ক্ষেত্রে অনেকে মন্দকে মন্দ বলে মনে করে না ।
আমরা এবার দুইটি কাহিনী শুনব এবং লক্ষ করব কারা সুন্দর বিবেকের মানুষ এবং কারা অসুন্দর বিবেকের মানুষ, কাদের জীবন উন্নত ও সুন্দর মূল্যবোধ রয়েছে এবং কাদের জীবনে এগুলো অনুপস্থিত ।
উদাহরণ ১
বাবু সুজন এবং তার স্ত্রী তেরেজা তাদের তিন মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে সুখের সংসার করে আসছেন । ভালো খ্রিষ্টান হিসেবে গ্রামে এবং মণ্ডলীতে তাদের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে । গ্রামের সবার সাথে তাদের সদ্ভাব রয়েছে । তাঁরা প্রতিদিন সন্ধ্যায় সন্তানদের নিয়ে প্রার্থনা করেন, প্রতি রোববার তারা গির্জায় যান । যীশুর মঙ্গলসমাচার প্রচারের উদ্দেশ্যে তাদের এক মেয়ে সিস্টার এবং এক ছেলে পুরোহিত হয়েছে, এবং মানবসেবায় নিজেদের সমর্পণ করেছে । অন্য সন্তানেরাও পড়াশুনা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে । অনেকে মন্তব্য করেছে, এটি একটি আদর্শ পরিবার ।
উদাহরণ ২
প্রেম ঘটিত তুচ্ছ ঘটনায় গ্রামের টনি নামের এক যুবকের সাথে এক পরিবারের বিবাদ হয়। বিবাদের এক পর্যায়ে টনি তার মাস্তান বন্ধুদের নিয়ে ঐ পরিবারের কয়েকজনকে মারধোর করে । ঐ ঘটনার জের ধরে
পুলিশ টনিকে আটক করে থানায় নিয়ে যায় এবং পরে জেলে দেয় । টনির বিরুদ্ধে গ্রামের অনেকের কাছ থেকে বিভিন্ন রকমের অভিযোগ শোনা গেল । তার পরিবার সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেল যে, টনির বাবা-মার অবস্থা তেমন সচ্ছল নয় এবং তাদের পারিবারিক পরিবেশও ভালো নয় । স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নানান কারণে প্রায়ই ঝগড়াঝাটি হয়, তারা সন্তানদেরকে এবং পাড়া প্রতিবেশীদেরকেও বিশ্রী বিশ্রী ভাষায় গালাগালি করে । গির্জা-প্রার্থনায় খুব একটা যায় না, বাড়িতেও সান্ধ্য-প্রার্থনা খুব কমই হয় । বাবা অনেক সময় রাতে মদ খেয়ে এসে স্ত্রীকে ও ছেলেমেয়েদেরকে খুব গালাগালি করে এবং তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে । গ্রামের সবাই ভাবে, “এই পরিবারের ভবিষৎ কী” ?
এভাবে অনেক মানুষের জীবনে আমরা দেখতে পাই ভালো মূল্যবোধ আছে বলে তাদের আচরণগুলো ভালো । কিন্তু যাদের মূল্যবোধগুলো খারাপ তাদের আচরণগুলোও খারাপ হয়ে থাকে ।
কাজঃ সঠিক বিবেক ও ভ্রান্ত বিবেকের জন্ম, কারণসমূহ, প্রকাশ ও পরিণতি বা ফলাফল সম্পর্কে দলে আলোচনা কর । |
মূল্যবোধের উৎস
মানুষের মধ্যে মূল্যবোধের দুইটি উৎস রয়েছে: অন্তর্নিহিত উৎস এবং বহিরাগত উৎস ।
ক. অন্তর্নিহিত উৎস
ঈশ্বর মানুষকে তার নিজের মতো করে সৃষ্টি করেছেন। পবিত্র বাইবেলের আদিপুস্তকে বলা হয়েছে: “এসো আমরা নিজ প্রতিমূর্তিতে ও সাদৃশ্যে মানুষ সৃষ্টি করি” (আদি ১:২৬)। কাজেই আমাদের প্রত্যেকের নিজ সত্তার গভীরে রয়েছে ঈশ্বরের রোপিত উত্তমতা ও সৌন্দর্য । আলোয়-ভরা চোখ দিয়ে আমরা ঈশ্বরের দেওয়া উত্তমতা ও সৌন্দর্যকে দর্শন করতে পারি । ঈশ্বরের গভীর ভালোবাসায় আমরা সৃষ্ট হয়েছি যা আমাদের হৃদয়-গভীরে উৎসারিত হতে থাকে পুণ্য-কর্ম ও সুন্দর কর্ম সাধনের সাধনায় ।
এই যে অন্তর্নিহিত উত্তমতা, যা সর্বোপরি ঈশ্বরকে পাবার জন্যে ধাবিত হয়, তা আমাদের পাপের কারণে মলিন ও নিষ্প্রভ হতে পারে; কিন্তু এর বীজ কখনো ধ্বংস হয় না । তা আমাদের সত্তার মধ্যে থেকে ঈশ্বরের ভালোবাসায় বাস করতে থাকে । সুযোগ পেলেই তা আলোকিত জীবনের উদ্দেশ্যে ফুটে ওঠে ।
খ. বহিরাগত উৎস
দুইভাবে মানুষের মধ্যে বহিরাগত মূল্যবোধসমূহ কাজ করে । তা হলো: পারিপার্শ্বিক সমাজ এবং ঐশ প্রত্যাদেশ । কোন মানুষই একাকী বাস করতে পারে না; সে একটি পরিবারে ও সমাজে বাস করে । কাজেই সে তার পরিবার ও সমাজের প্রচলিত ও কৃষ্টিগত মূল্যবোধের দ্বারা প্রভাবিত । যেমন, গুরুজনদের শ্রদ্ধা করা, পরিবার ও সমাজের নিয়ম-কানুন মেনে চলা, মিলেমিশে থাকা, ইত্যাদি। অন্যদিকে, প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনো ধর্ম বা মতবাদে বিশ্বাসী । ধর্মীয় শিক্ষা ও বিধানসমূহ বা ঐশ প্রত্যাদেশসমূহ মানুষের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ গঠনে প্রভূত সাহায্য করে ।
বিবেকের গঠন
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মূল্যবোধ ও বিবেকের মধ্যে একটা সম্পর্ক রয়েছে । এই দুইটি একে অপরকে প্রভাবিত করে, মানুষের নৈতিকতাবোধ ও ব্যক্তিত্ব গঠনে অবদান রাখে । যেহেতু মানুষের মূল্যবোধ দুইভাবে গঠিত হয় অর্থাৎ সে অন্তর্নিহিত ও বহিরাগত মূল্যবোধের সৃষ্টি করে, তাই মানুষের বিবেক গঠিত হয় প্রধানত: দুইটি উপায়ে: অন্তর্নিহিত নৈতিক মূল্যবোধ এবং বহিরাগত মূল্যবোধ দ্বারা ।
ক. অন্তর্নিহিত বিবেক
ঈশ্বর প্রত্যেক মানুষকে তার উত্তমতা ও সৌন্দর্য দান করেছেন (আদিপুস্তক ৩:২৬) । ফলে প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর প্রদত্ত বিবেচনা শক্তি রয়েছে, যার ফলে সে চিনে নিতে পারে নৈতিক মূল্যবোধসমূহ; বিচার করতে পারে কোনটি ভালো, কোনটি মন্দ; বুঝতে পারে কোনটি করা তার উচিত, কোনটি উচিত নয়, আর সে অনুসারে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে । নিজের বিবেকের সিদ্ধান্ত অনুসারেই সে কাজ করে । এই ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি যত বেশি ঈশ্বর ভীরু, ধর্মপরায়ণ ও পবিত্র হয়, তার বিবেক তত সুন্দর হয় । রাজা সলোমনকে এই ক্ষেত্রে একজন বড় আদর্শ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে (১ রাজাবলি ৩:৪-১৪)।
খ. বহিরাগত বিবেক
মূল্যবোধের মতোই আমাদের বিবেকের গঠনে অপরের প্রভাব অপরিসীম । পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, দেশীয় ও বিশ্ব-সংস্কৃতির মূল্যবোধ চেতনা এবং নৈতিক মানদণ্ডসমূহ আমাদের বিবেকের গঠন প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে । পারিবারিক ও সামাজিক ধর্মীয় চর্চা, ঈশ্বর প্রেম ও মানব প্রেম, সুন্দর বিবেক গঠনে সাহায্য করে । অন্যদিকে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব সংস্কৃতির নেতিবাচক নিয়ম-নীতি মানুষের সুন্দর ও পবিত্র বিবেক গঠন বাধাগ্রস্ত করে । উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, কন্যা শিশুর প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের কারণে অনেক গর্ভস্থ কন্যাশিশুকে হত্যা করা হচ্ছে । অনেক রাষ্ট্রে গর্ভপাতের মাধ্যমে নরহত্যার অপরাধকে আইন-সিদ্ধ করা হয়েছে । চীন দেশের এক-সন্তান নীতির কারণে প্রতি বছর কোটি কোটি মানব- ভ্রুণ হত্যা করা হচ্ছে । পতিতাবৃত্তির মতো ঘৃণ্য মন্দ কাজকে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই রাষ্ট্রীয় আইনে বৈধতা দেওয়া হয়েছে ইত্যাদি । ফলে এসব পাপ কাজকে অনেকে আজ আর মন্দ কাজ বা পাপ কাজ বলে মনে করছে না। বহিরাগত ইতিবাচক এবং নেতিবাচক নৈতিক মানদণ্ড আমাদের বিবেকের গঠনকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে ।
ব্যক্তিগত বিবেক
বলা হয়ে থাকে যে, “প্রত্যেক মানুষ তার কাজের জন্যে দায়ী।” কথাটা মেনে নেবার জন্যে কখনো কখনো প্রশ্নের উদ্ভব ঘটতে পারে । পরিপক্ক মানুষ যখন স্বাধীনভাবে তার নিজের সিদ্ধান্ত অনুসারে কোনো কাজ করে তখন সে সম্পূর্ণরূপে সেই কাজের জন্যে দায়ী থাকে । কিন্তু কখনো কখনো কিছু মানুষ স্বেচ্ছায় স্বাধীনভাবে কিছু কাজ করে না। হয় সে কর্তৃপক্ষের বা গুরুজনের আদেশের বশবর্তী হয়ে কোনো কাজ করছে নতুবা কারো প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি বা কারো মনতুষ্টির জন্যে সে কাজ করছে । এরূপ ক্ষেত্রে কোনো কাজের জন্যে সেই ব্যক্তিকে পুরোপুরি দায়ী করা যায় না ।
শিশুরা অনেক সময় অনেক কাজই করে থাকে তাদের পিতামাতা ও গুরুজনদের আদেশ মেনে নিয়ে; স্কুলে তারা অনেক কিছু করে স্কুলের নিয়মকানুনের জন্যে এবং শাস্তির ভয়ে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিবারের ও স্কুলের শেখানো মূলবোধগুলো নিজের করে নিয়ে সুন্দর বিবেক গঠন একান্ত প্রয়োজন । যে ব্যক্তি সব সময় অন্যের আদেশ শুনে বা নিয়মের বশবর্তী হয়ে কাজ করে তার মধ্যে কখনো জীবনের পরিপক্কতা আসে না । পরিপক্ক মানুষমাত্রই স্বাধীনভাবে এবং নিজের সিদ্ধান্তে তার কাজ-কর্ম করে থাকে । তাই সে তার ভালো- মন্দ সব কাজের জন্যে দায়ী থাকে ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লক্ষ লক্ষ ইহুদি নারী-পুরুষকে হত্যার দায়ে এই জঘন্য অপরাধের জন্যে আইচম্যান নামে কুখ্যাত এক ব্যক্তিকে দায়ী করা হয় । যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যখন তাকে বিচারের জন্যে আদালতে উপস্থিত করানো হয় তখন এই বলে সে নিজেকে নির্দোষ বলে ঘোষণা করল যে, সে যা কিছু করেছে সবই করেছে কর্তৃপক্ষের আদেশের কারণে । ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের সময় যে- সব পাকিস্তানি সেনা ত্রিশ লক্ষ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে, বহু নারীকে ধর্ষণ করেছে এবং হাজার হাজার বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে, তাদেরও যদি প্রশ্ন করা যেত কেন তারা তা করেছে, তারাও হয়ত উত্তরে বলত যে, কর্তৃপক্ষের আদেশেই তারা তা করেছে ।
অন্যদিকে, অতিরিক্ত স্বাধীন চেতনার বিবেকবান মানুষেরও একটা বিপদজনক দিক রয়েছে । এরূপ ব্যক্তি সহজেই ভাবতে পারে: “আমি যা করেছি, ভেবে চিন্তেই করেছি”; “আমি যা ঠিক মনে করেছি, তাই করেছি । আমি কারো মতামতের ধার ধারি না এই ধরনের মনোভাব এবং বিবেকবোধ সেই ব্যক্তিকে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় । এক্ষেত্রে সমাজের অন্য মানুষের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, প্রত্যাশা, অনুভূতি এবং পছন্দ-অপছন্দকে সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করা হয় । এই পৃথিবীতে আমরা কেউ-ই ‘একা’ নই, অন্যের সান্নিধ্যে ও সাহচর্যেই আমরা বাস করি এবং বেড়ে উঠি
এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে । কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র দীপ হঠাৎ করে তার পড়াশুনা বন্ধ করে দিল । অন্যের প্রশ্নের উত্তরে সে জানাল যে, পড়াশুনা তার ভালো লাগে না । দীপ বেশি করে তার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে শুরু করল, আস্তে আস্তে সে নেশায় জড়িয়ে পড়ল । বাড়ি থেকে টাকা পয়সা এবং মূল্যবান সামগ্রী চুরির অভ্যাসে পরিণত হলো। বাবা-মা দীপকে ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য দীপের ছোটবেলা থেকেই তেমন ফলপ্রসূ কোনো ভূমিকা পালন করেনি। পুলিশ দীপকে কয়েকবার বিভিন্ন অপরাধে জেল হাজতে দিল । কিন্তু প্রতিবারই তার পিতামাতা তাকে ছাড়িয়ে আনল । এই ঘটনায় দীপ ও তার পিতামাতা উভয়েরই ত্রুটিপূর্ণ বিবেক লক্ষ করা যায় ।
পরিপক্কতায় বৃদ্ধিলাভ
পরিপক্ব বিবেক-সম্পন্ন মানুষরূপে বেড়ে ওঠার জন্যে নিম্নোক্ত দুইটি বিষয় অতি গুরুত্বপূর্ণ:
ক. পরিপক্ক বিবেকবান মানুষরূপে বেড়ে ওঠা
পরিপক্ব বিবেকবান মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠা হলো সারা জীবনের কাজ । এটা প্রতিটি মানুষের সারা জীবনের ধ্যান ও সাধনা । জ্ঞান হওয়া থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত এই সাধনা চলে । ব্যক্তিগত ও দলীয় চিন্তা ধ্যান আমাদের নিজেদেরকেই বুঝতে সাহায্য করে, “আমার জীবনের মূল্যবোধ কেমন হওয়া প্রয়োজন ।”
এরূপ ব্যক্তিগত ও দলীয় চিন্তা-ধ্যান আমাকে বুঝতে সাহায্য করে যে, আমি জন্মলগ্ন থেকেই একটি সমাজে বাস করে আসছি যার ধ্যান-ধারণা আমার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমান বিশ্ব হয়ে উঠেছে একটি পরিবার, একটি সমাজ । এটি দ্রুত পরিবর্তনশীল । ফলে প্রতিদিন নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হচ্ছে। এই আবিষ্কারমুখর ও দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে নতুন কোনো কিছুকে সচেতনভাবে দেখা ও গ্রহণ করার জন্য আমাদের বিবেকের নব জাগরণ প্রয়োজন ।
খ. ব্যক্তি ও সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা
মানুষ ও সমাজ পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। প্রতিটি মানুষের জন্ম-জীবন-মৃত্যু সমাজের মধ্যেই । সমাজের মধ্যেই তার বৃদ্ধি লাভ এবং তার বিবেক ও মূল্যবোধের স্বীকৃতি । অন্যদিকে, ব্যক্তি ছাড়া সমাজ অকল্পনীয় ও অস্তিত্বহীন । কাজেই প্রত্যেক মানুষকে সচেতনভাবে লক্ষ রাখতে হয় যেন সে নিজের ব্যক্তিগত বিবেক ও সমাজ এই দুইয়ের পরস্পরের সাথে সম্মিলনে তার মূল্যবোধসমূহ গড়ে তুলতে পারে। কাজেই আমাদের মূল্যবোধগুলোর পুনর্মূল্যায়ন একান্ত প্রয়োজন এটি জানার জন্যেই যে, সেগুলো কতটুকু আমার ও সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বৃদ্ধি পাচ্ছে । শুধুমাত্র নিজের বিবেক অনুযায়ী মূল্যবোধগুলো নির্ধারণ করলে সমাজকে যেমন অগ্রাহ্য করা হয়, তেমনিভাবে শুধু সমাজের মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হলে মানুষের নিজস্ব বলে আর কিছু থাকে না; সে হারিয়ে যায় । তাই ব্যক্তিকে সমাজের মূল্যবোধগুলো থেকে নিজের বিচার- বিবেচনায় ভালোগুলোকে যাচাই-বাছাই করে নিতে হয়। যেমন: বর্তমান সমাজে ভালো-মন্দ বিচিত্র ধরনের সংবাদ মাধ্যম পত্র-পত্রিকা ও আকাশ-সংস্কৃতি প্রচলিত রয়েছে। ব্যক্তি মানুষকে ভেবে-চিন্তে বাছাই করে নিতে হয়, কোন মূল্যবোধগুলো তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ, উন্নত জীবন এবং সঠিক নৈতিক মূল্যবোধ গঠনে সহায়ক । তখনই মাত্র একজন মানুষ সঠিক ও সুন্দরভাবে তার জীবনকে পরিচালনা করতে পারবে ।
এইডস, ধূমপান ও মাদকাসক্তি
মূল্যবোধগুলো রেল লাইনের মতো । রেল লাইন যেমন করে রেলগাড়িকে সঠিক স্থানে পৌঁছাতে সহায়তা করে তেমনি সঠিক মূল্যবোধ মানুষকে সঠিক লক্ষ্যের দিকে চালিত করে । কিন্তু যার জীবনে সঠিক মূল্যবোধ থাকে না সে অনায়াসে মন্দ দিকে আসক্ত হয়ে জীবনের গতিপথ থেকে হারিয়ে যেতে পারে। এরকম ব্যক্তি নানা রকম মন্দ নেশায় আসক্ত হয়ে যেতে পারে, খারাপ বন্ধুর পাল্লায় পড়ে মারাত্মক মরণব্যাধি এইডস-এর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে। সেজন্য তারুণ্যের এই বয়সে আমাদের ধূমপান ও মাদকাসক্তির খারাপ প্রভাব এবং এইডস্ ও এইআইভি সম্পর্কে কিছু ধারণা থাকা আবশ্যক । এগুলোর বিষয়ে জেনে আমরা মন্দ জীবন যাপন থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করব।
মারাত্মক মরণ-ব্যাধি এইডস্ ও এইচআইভি
বর্তমান বিশ্বে এইডস্ একটি মারাত্মক মরণ-ব্যাধি হিসেবে বিবেচিত । কোনো কোনো দেশে বিশেষভাবে, আফ্রিকা মহাদেশে এটির প্রকোপ ও বিস্তার এত বেশি যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আমাদের সকলের জন্যে এটি একটি দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । বাংলাদেশেও এর মারাত্মক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে এবং দিন দিন এইডস্ আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
এইডস্ ও এইচআইভি (AIDS ও HIV) কতগুলো ইংরেজি শব্দসমষ্টির প্রথম অক্ষর দ্বারা তৈরি। শব্দ দুইটি এখন সারা বিশ্বে প্রচলিত ।
AIDS শব্দটির উৎপত্তি : Acquired Immuno Deficiency Syndrome
HIV শব্দটির উৎপত্তি: Human Immunodeficiency Virus
সাধারণত AIDS এবং HIV পাশাপাশি লেখা হয় । এর দ্বারা বুঝানো হয় এমন একটি রোগকে, যে রোগে আক্রান্ত হলে মানবদেহ রোগ সংক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা হারায় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায়শ মারা যায় ।
এইডস্ রোগ ও এইডস্ আক্রান্ত মানুষের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি
আমাদের সমাজের লোকেরা এইডস্ রোগে আক্রান্ত রোগীকে দারুণ ভয় ও ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে থাকে । এইডস্ সম্বন্ধে কোনো জ্ঞান না থাকায় অনেকে এটাকে অবৈধ যৌন সম্পর্কের দ্বারা সৃষ্ট পাপের ফল ও পাপের শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে ধর্মীয় ও নৈতিক দিক থেকেও এইডস্-কে একটি মারাত্মক পাপ ও নৈতিক অবক্ষয় এবং এইডস্ আক্রান্ত মানুষকে ‘পাপী' হিসেবে বিবেচনা করা হয় । ফলে এইডস্ আক্রান্ত মানুষ হয়ে ওঠে সকলের ঘৃণার পাত্র/পাত্রী এবং সমাজে সে হয় ‘এক-ঘরে’ । তার পক্ষে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা হয়ে ওঠে অসম্ভব । তাই এইডস্ আক্রান্ত মানুষ জীবিত থেকেও যেন মৃত । তার যেন কোনো মানবীয় মর্যাদা নেই, সম্মান নেই, কোনো ধর্মীয় উৎসব, বিবাহ ও সামাজিক অনুষ্ঠানে তার কোনো স্থান নেই।
কীভাবে এইডস্-এর বৃদ্ধি প্রতিরোধ করা যায়? বর্তমান বিশ্বে চিকিৎসাবিদগণ ও ধর্মীয় চিন্তাবিদগণ এইডস্ রোগের বৃদ্ধি প্রতিরোধ করার লক্ষে A-B-C পদ্ধতির কথা জোর দিয়ে প্রচার করছেন ।
A=Abstain/Avoid বা বিরত থাক/এড়িয়ে চল: অবিবাহিত যুব-কিশোরীদের পবিত্র বিবাহ বন্ধন ব্যতীত যৌন সম্পর্ক থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা; বিবাহিত নারী-পুরুষের জন্যে জীবন সঙ্গী-সঙ্গিনী ব্যতীত যে-কোনোরূপ যৌন সম্পর্ক সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলা। B=Be Faithful বিশ্বস্ত থাক: যুবকযুবতী বা কিশোরকিশোরী হিসেবে জীবনের পবিত্রতা সতীত্বের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা; বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী হিসেবে মৃত্যু পর্যন্ত বিশ্বস্ত থাকা । C=Change of Behaviour বা আচরণের পরিবর্তন: জীবনের মন্দ অভ্যাসের পরিবর্তন হলো জীবনের শুচিতা ও খ্রিষ্টীয় মুক্তি লাভের উত্তম পথ ।
তবে এইডস্ রোগের বৃদ্ধি প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের আরও মনে রাখতে হবে যে, কেবলমাত্র শারীরিক সম্পর্কের দ্বারাই এ রোগ ছড়ায় না । রোগীর ব্যবহৃত ইনজেকশনের সুঁচ ব্যবহার করলে, এইডস্ রোগীর রক্ত গ্রহণ করলে, এইডস্ আক্রান্ত মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করলে ও সেই মায়ের দুধ পান করলে, এইডস্ রোগীর কাছ থেকে অঙ্গ নিয়ে তা প্রতিস্থাপন করলে ইত্যাদি কারণেও এইডস্ রোগ ছাড়াতে পারে । তাই এ সব ব্যাপারে আমাদের সাবধান থাকতে হবে ।
নেশায় জীবন ধ্বংস
“আমার ছেলে আমাদের সর্বনাশ করেছে, আমাদের সংসার ধ্বংস করে দিয়েছে...।” কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন বিলাসের মা এবং চোখের জল মুছছিলেন । কী হয়েছে, জানতে চাইলে তিনি বলতে
লাগলেন: “আমার ছেলে খুব ভালো ছিল । ছোটবেলা থেকেই সে আমাদের বাধ্য হয়ে চলত । ওর নামে কোনদিন কোন অভিযোগ কারো কাছ থেকে শোনা যায়নি । ওকে নিয়ে আমরা কত গর্ব করতাম । ওকে নিয়ে আমাদের কত বড় স্বপ্ন ছিল । কিন্তু সব শেষ হয়ে গেছে; ও আমাদের সমস্ত আশা, আমাদের সব স্বপ্ন ধ্বংস করে দিয়েছে গত প্রায় দুই বছর ধরে ওকে নিয়ে আমরা অনেক কষ্টের মধ্যে রয়েছি। ওর কিছু বন্ধুদের সাথে ও নেশায় জড়িয়ে যায় । কত মিথ্যা বলে বলে ও আমার কাছ থেকে কত বার টাকা নিয়েছে । ওর বাবা এই নিয়ে আমার ওপর কতবার রাগারাগি করেছে । আমি ছেলেকে ভালোবাসি বলে ওর সব কথা সত্য বলেই মনে করতাম । কিন্তু আস্তে আস্তে দেখছি ঘরের অনেক জিনিস হারিয়ে যেতে লাগল । একদিন হয়তো দেখছি টেবিল ঘড়িটা নেই; অন্যদিন দেখছি মোবাইল ফোনটা নেই; আরেকদিন হয়তো দেখছি আমার জমানো টাকাগুলো নেই; হয়তো আরেকদিন দেখছি চাল নেই । আলমারীর অনেক জিনিসই এখন আর নেই ।”
নেশার শুরু ছোট্ট পদক্ষেপ দিয়ে
একদিন বিকেল বেলা সুমন তার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বের হলো। মাঠের এক কোণায় এসে তারা জড়ো হলো । তারপর একজন সিগারেট বের করল এবং তারা ধূমপান করতে শুরু করল । তারা সুমনকে একটা সিগারেট দিল আর সে-ও ধূমপান করতে শুরু করল । আস্তে আস্তে তার বেশ ভালো লাগছে বলেই মনে হলো । আর এভাবেই সে ধীরে ধীরে হিরোইনের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ল । তারপর যা হবার, তা-ই হলো । পড়াশুনা বন্ধ হলো: ঘরের নানান জিনিসপত্র চুরি হতে শুরু হলো: মিথ্যা বলা অভ্যাসে পরিণত হলো । পাড়ার মানুষ ছি: ছি: করতে শুরু করল । শেষে তার স্থান হলো মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ।
নেশার পরিণতি
আজ সারা বিশ্বে বিলাস আর সুমনের মতো অনেক শিশু-কিশোর ও যুবক-যুবতীর সুন্দর জীবন কুৎসিত-ঘৃণিত জীবনে পরিণত হচ্ছে । নেশার কারণে যে সব মন্দ পরিণতিগুলো লক্ষ করা যায়, সেগুলো নিম্নরূপ:
১. মিথ্যা বলা অভ্যাসে পরিণত হওয়া
২. চুরি করার প্রবণতা
৩. পিতামাতা ও গুরুজনদের অবাধ্য হওয়া এবং তাঁদের সাথে অশোভন আচরণ করা
8. পরিবারিক প্রার্থনা ও গির্জা-উপাসনায় অনুপস্থিতি
৫. নৈতিক জীবনে অধঃপতন ইত্যাদি ।
এসো নেশাকে ‘না' বলি
বিলাস আর সুমনের মতো আজ অনেক মা-বাবার চোখে জল: তাদের আদরের সন্তানকে নিয়ে গর্ব করা তো দূরের কথা, লজ্জায় সমাজে আজ মুখ দেখানেই দারুণ কষ্ট । প্রত্যেক পিতামাতাই চান তাদের সন্তানদের সুন্দর জীবন । তাদের একান্ত কামনা ও প্রার্থনা সন্তানেরা প্রতিষ্ঠিত হোক, পরিবার ও বংশের সুনাম বয়ে আনুক । কাজেই প্রত্যেক শিশু-কিশোর ও যুবক-যুবতীর কর্তব্য তাদের পিতামাতার মতো নিজেদের জীবনের জন্যে সুন্দর স্বপ্ন দেখা এবং সেইভাবে জীবন যাপন করা । তাই সুন্দর জীবন গড়ার মন্ত্রে প্রত্যেক শিশু-কিশোর ও যুবক-যুবতী নিজেরাই নিজেদের কাছে এই শপথ করুক: “আমি কখনো কোনরূপ নেশা করব না ।” এটা হোক তাদের জীবনের একটা মহান ব্ৰত ।
মঙ্গলসমাচারের মূল্যবোধ
পবিত্র মঙ্গলসমাচারের মূল্যবোধসমূহই হলো প্রত্যেক খ্রিষ্টভক্তের মূল্যবোধের উৎস ও আদর্শ । যীশু নিজেই এই মূল্যবোধগুলো তাঁর শিষ্যদের শিখিয়েছেন এবং তাদের আদেশ দিয়েছেন অন্যদের তা শিক্ষা দিতে: “তোমরা জগতের সকল মানুষের কাছে যাও . . . এবং আমি তোমাদের যা কিছু করতে নির্দেশ দিয়েছি, তা তাদের পালন করতে শেখাও” (মথি ২৮: ১৯-২০)।
পবিত্র মঙ্গলসমাচারের মূল্যবোধগুলোই আমাদের জীবনের নৈতিক মূল্যবোধ ও পবিত্র সুন্দর জীবনের ভিত্তি ও চালিকাশক্তি । খ্রিষ্টভক্তকে তাই বিশ্বস্তভাবে যীশুর বাণী পাঠ ও অনুধ্যান করে যীশুর শেখানো মূল্যবোধগুলোর সাথে পরিচিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন এবং সেই অনুসারে জীবন যাপন করা একান্ত প্ৰয়োজন । আমরা যেন যীশুর শেখানো মূল্যবোধগুলো আমাদের নিজের করে নেই এবং সেগুলো দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে জীবন যাপন করি এ বিষয়ে যীশু বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন । যীশুর শেখানো মূল্যবোধগুলোই হলো আমাদের জন্যে একমাত্র সত্য, পথ ও পূর্ণ মুক্তির পথ । তাই যীশু বলেন: “আমিই পথ, আমিই সত্য, আমিই জীবন” (যোহন ১৪: ৬)।
প্ৰাৰ্থনা
সঠিক বিবেক ও যথাযথ মূল্যবোধ লাভের জন্যে আমাদের কর্তব্য হলো প্রতিদিন ঈশ্বরের কাছে এর জন্যে প্রার্থনা করা । রাজা সলোমনের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরা প্রতিদিন এভাবে প্রার্থনা করতে পারি :
হে প্রভু, আমাকে তোমার জ্ঞান দান কর যেন আমি সঠিক ও স্পষ্টভাবে ভালো ও মন্দের ব্যবধান চিনতে পারি এবং সত্য সঠিক পথে প্রতিদিন জীবন যাপন করি ।
কাজ : “নেশা সর্বনাশা জীবন বিনাশকারী” এ শিরোনামের ওপর একটি প্রতিবেদন লিখে শ্রেণিতে উপস্থাপন কর । |
অনুশীলনী
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১. আমাদের বিবেককে কী বলা যায় ?
ক. আমাদের গোপন অন্তঃস্থল
গ. আমাদের সুপ্ত প্রতিভা
খ. আমাদের অধ্যবসায়
ঘ, আমাদের ধার্মিকতা
২. অতিরিক্ত স্বাধীনচেতা মানুষ কেমন হয় ?
ক. ত্যাগস্বীকার করে না
খ. অল্পতেই ভেঙ্গে পড়ে
গ. অন্যের মতামত গ্রাহ্য করে না
ঘ. অন্যের সমালোচনা করে
নিচের অনুচ্ছেদটি পড়ে ৩ ও ৪নং প্রশ্নের উত্তর দাও :
রমেশ খুব ধার্মিক কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে তিনি বেকার । কোনো চাকুরি তিনি পাচ্ছেন না। তিনি প্রতিদিন সন্ধ্যায় স্ত্রী-সন্তানদের সাথে প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করেন না। তার চাকুরি হচ্ছে না, হচ্ছেই না ৷ আৰ্থিক অনটনের কারণে তার মন খারাপ, তাই তিনি অনেক রাতে বাড়ি ফিরেন । স্ত্রী-সন্তানের মন পান না । অবশেষে তিনি তার ভুল বুঝতে পেরে তার আচরণ পরিবর্তন করেন । তাঁর একটি ভালো চাকরি হলো ।
৩. কিসের তাড়নায় রমেশ তার আচরণ পরিবর্তন করেন ?
ক. অভাবের
খ. বিবেকের
গ. অনুভূতির
ঘ. আবেগের
৪. নিজের ভুল বুঝে ভালো পথে ফিরে না আসলে রমেশের
i. মূল্যবোধের অবক্ষয় হতো
ii. ধার্মিকতা হ্রাস পেত
iii. সামাজিক দায়বদ্ধতা বাড়ত
নিচের কোনটি সঠিক ?
ক. i
খ. ii
গ. i ও ii
ঘ. i ও iii
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. মূল্যবোধ বলতে কী বুঝ ?
২. মূল্যবোধের অন্তর্নিহিত উৎস বলতে কী বোঝায় ?
৩. বিবেকের গঠন কীভাবে করা সম্ভব ?
৪. এইডস্ কী ?
৫. নেশাকে 'না' বলতে হয় কেন ?
সৃজনশীল প্রশ্ন
১. দৃশ্যকল্প-১
আব্রাহাম ও তেরেজার সংসার । তাঁদের পরিবারটি হলো একটি খ্রিষ্টীয় পরিবার । গ্রামের লোকদের সাথে তাঁদের সম্পর্ক খুবই সুন্দর । তাঁরা প্রতি রবিবার গির্জায় যান এবং সন্ধ্যায় বাড়িতে সবাইকে নিয়ে প্রার্থনা করেন । সন্তানদের সুশিক্ষা দিয়ে বড় করছেন । গ্রামের হতদরিদ্র লোকদের বিপদে আপদে তারা পাশে দাঁড়ান।
দৃশ্যকল্প-২
বিধান ও প্রমিলা ভালোবেসে সংসার সাজালেও কিছুদিন পরই তাদের মধ্যে ঝগড়া, মনোমালিন্য ও অবিশ্বাস শুরু হয় । সামান্য ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে প্রায়ই তাদের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি হয় । তাঁদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদের কারণে বিধান তার স্ত্রী প্রমিলাকে ভীষণ মারধর করেন ।
ক. মূল্যবোধের সাথে কিসের গভীর সম্পর্ক রয়েছে ?
খ. মানুষের জীবনে মূল্যবোধসম্পন্ন জ্ঞানের প্রয়োজন কেন ?
গ. কোন্ শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আব্রাহাম ও তেরেজা সুখী সংসার গঠন করেন – ব্যাখ্যা কর ।
ঘ. বিধান ও তার স্ত্রীর মধ্যে সুন্দর বিবেকের কি সমন্বয় ঘটেছে বলে তুমি মনে কর ? তোমার মতামত তুলে ধর ।
২. পায়েলের শৈশবকাল ছিল খুবই সুন্দর । বরাবরই সে শ্রেণিতে ভালো ফল করত । মা-বাবা তাকে নিয়ে খুবই গর্বিত ছিলেন এবং ভবিষ্যতে সে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে বলে তাদের ধারণা ছিল । নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নাবস্থায় তার পিতামাতা লক্ষ করছেন যে পায়েল বাজে ছেলেদের সাথে চলাফেরা করে, পরীক্ষায় খারাপ ফল করছে । সন্ধ্যার পূর্বেতো বাড়ি ফিরেই না বরং মাঝে মাঝে অনেক রাতে নেশা করে বাড়ি ফিরে । তার পিতামাতা তাকে নিয়ে অনেক চিন্তিত । তাকে ভালো পথে ফিরিয়ে আনতে তারা অনেক চেষ্টা চালাচ্ছেন কিন্তু প্রতি পদক্ষেপই তারা ব্যর্থ হন । পরিশেষে পায়েল অনেক জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে । সুতরাং বলা যায়, ‘নেশাই পায়েলের জীবনকে কুরে কুরে ধ্বংস করে দিচ্ছে ।'
ক. বর্তমান বিশ্বে এইডস্ কী হিসেবে পরিচিত ?
খ. এইডস্ আক্রান্ত ব্যক্তি সমাজের ঘৃণার পাত্র হয়ে ওঠে কেন ?
গ. কোন শিক্ষাকে আয়ত্ব করে পায়েল জীবন পরিচালনা করতে পারত ? - ব্যাখ্যা কর ।
ঘ. পায়েল তার পথ থেকে ফিরে আসতে কী পদক্ষেপ নিতে পারে? – মূল্যায়ন কর ।
আরও দেখুন...